ইহরামের মূল বিষয় হচ্ছে হজ্ব বা উমরার নিয়তে তালবিয়া পাঠ। এর দ্বারাই ইহরাম সম্পন্ন হয়ে যায়।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাথায় সিঁথি করা অবস্থায় ইহরামের তালবিয়া পাঠ করতে দেখেছি। তিনি বলেছেন,

لَبَّيْكَ اللهُمَّ، لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لَا شَرِيكَ لَكَ  .

(লাব্বাইক আল্লা-হুম্মা লাব্বাইক-লাব্বাইক লা শারীকা লাকা লাব্বাইক ইন্নাল হামদা ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারীকা লাক।) -সহীহ মুসলিম ১/১৭৫

এই বাক্যগুলোর অতিরিক্ত কিছু বলেননি।

তবে ইহরাম করার সুন্নত তরীকা হল  মোচ, নখ এবং শরীরের পরিষ্কারযোগ্য লোম চেঁছে বা কেটে পরিষ্কার করবে। উত্তমরূপে গোসল করবে, গোসল সম্ভব না হলে ওযু করবে। পুরুষগণ দু’টি নতুন বা ধৌত করা সাদা চাদর নিবে। একটি লুঙ্গির মতো করে পরবে। অপরটি চাদর হিসাবে ব্যবহার করবে। পায়ের পাতার উপরের অংশ খোলা থাকে এমন চপ্পল বা স্যান্ডেল পরবে। মহিলাগণ স্বাভাবিক কাপড় পরবে। তাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় জুতা-মোজা পরার অবকাশ রয়েছে। ইহরাম বাঁধার আগে খালি শরীরে আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা মুস্তাহাব। শরীরের আতর বা ঘ্রাণ ইহরাম গ্রহণের পর বাকি থাকলেও অসুবিধা নেই। তবে ইহরামের কাপড়ে আতর বা সুগন্ধি না লাগালেই ভালো। কেননা ইহরামের কাপড়ে এমন গাঢ় আতর বা সুগন্ধি লাগানো নিষেধ, যা ইহরামের পরও বাকি থাকে। মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে ইহরাম বাঁধার আগে দুই রাকাত নফল নামায পড়বে। অতঃপর যে হজ্ব আদায়ের ইচ্ছা, সে অনুযায়ী নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করবে।

নিচে ইহরামের প্রতিটি বিষয় দলীলসহ আলোচনা করা হল

১. মোচ, নখ এবং শরীরের পরিষ্কারযোগ্য লোম  চেঁছে বা কেটে পরিষ্কার করা।

২. ইহরামের উদ্দেশ্যে উত্তমরূপে গোসল করা।

হযরত যায়েদ বিন ছাবেত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইহরাম করার জন্য গায়ের পোশাক খুলতে এবং গোসল করতে দেখেছেন। -জামে তিরমিযী ১/১০২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৫৮৪৭

গোসল সম্ভব না হলে ওযু করে নেওয়া।

মাসআলা : ঋতুমতী মহিলার জন্য ইহরামের আগে গোসল করা মুস্তাহাব। -গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ৬৯

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোনো নারী হায়েয বা নেফাস অবস্থায় মীকাতে পৌঁছলে গোসল করবে এবং ইহরাম গ্রহণ করবে। অতপর হজ্বের যাবতীয় কাজ করতে থাকবে। শুধু বাইতুল্লাহর তাওয়াফ ব্যতীত। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৭৪০

৩. পুরুষদের দু’টি সাদা চাদর প্রয়োজন হবে, যা নতুনও হতে পারে কিংবা ধোয়াও হতে পারে। একটি লুঙ্গির  মতো করে এবং অপরটি চাদর হিসাবে পরিধান করবে। কালো রংয়ের কিংবা পুরুষের জন্য অনুমোদিত এমন যেকোনো রংয়ের কাপড় পরিধান করাও জায়েয।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ চুল আঁচড়ালেন, তেল লাগালেন এবং লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করে মদীনা থেকে হজ্বের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। তিনি জাফরানযুক্ত ব্যতীত অন্য কোনো চাদর ও লুঙ্গি পরতে নিষেধ করেননি। -সহীহ বুখারী ১/২০৯

৪. পায়ের পাতার উপরের উঁচু অংশ খোলা থাকে এমন চপ্পল বা স্যান্ডেল পরা।

৫. মহিলাগণ স্বাভাবিক পোষাক পরবে।

আসওয়াদ ও আলকামা রাহ. বলেন, মহিলাগণ ইহরাম অবস্থায় নিজ অভিরুচি মাফিক পোষাক পরিধান করতে পারবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৪৪১৯

মাসআলা : মহিলাগণ ইহরাম অবস্থায় জুতা-মোজা ব্যবহার করতে পারবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. মহিলাদেরকে ইহরাম অবস্থায় চামড়ার মোজা এবং পাজামা পরার অনুমতি দিতেন। তিনি বলেন, ছফিয়্যা রা. চামড়ার মোজা পরিধান করতেন, যা ছিল তাঁর হাটু পর্যন্ত। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস : ১৫৯৬৯ আরো দেখুন : হাদীস ১৫৯৬৫

মহিলাগণ হাত মোজা ব্যবহার করতে পারবে।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, মহিলাগণ ইহরাম অবস্থায় হাত মোজা এবং পাজামা পরিধান করতে পারবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৪৪৪০

বিখ্যাত তাবেয়ী কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ রাহ. বলেন, ইহরাম গ্রহণকারিনী হাত-মোজা ও পাজামা পরিধান করবে এবং পূর্ণ মুখম-ল আবৃত রাখবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৫৯৬৮

৬. ইহরাম করার আগে খালি শরীরে আতর বা সুগন্ধি  ব্যবহার করা মুস্তাহাব। শরীরের আতর ও ঘ্রাণ যদি ইহরাম বাঁধার পর অবশিষ্ট থাকে তবুও কোনো অসুবিধা নেই।

উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম গ্রহণের সময় তাঁর সর্বাধিক উত্তম সুগন্ধিটি ব্যবহার করতেন। তিনি বলেন, ইহরাম বাঁধার পর তাঁর শ্মশ্রু ও শির মোবারকে তেলের ঔজ্জ্বল্য দেখতে পেতাম। -সহীহ মুসলিম ১/৩৭৮

৭. মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে ইহরাম করার পূর্বে দুই রাকাত নফল নামায পড়া। -গুনইয়াতুন নাসিক ৭৩; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ৯৯; রদ্দুল মুহতার ২/৪৮২

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্বের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে রওনা হয়ে যুলহুলাইফাতে পৌঁছলেন এবং দুই রাকাত নামায পড়লেন। অতপর যুলহুলাইফার নিকট যখন উটনী তাঁকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল তখন তিনি তালবিয়া পাঠ করলেন…। -সহীহ মুসলিম ১/৩৭৬

৮. ইহরাম : (পুরুষ হলে তখন টুপি বা মাথায় কোনো কাপড় থাকলে খুলে ফেলতে হবে)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, মুখম-ল ও তার উপরের অংশ মাথার অন্তর্ভুক্ত। অতএব ইহরাম গ্রহণকারী থুতনী থেকে উপরের কোনো অংশ আবৃত করবে না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৪৪৫২

মাসআলা : তামাত্তুকারী প্রথমে শুধু উমরার নিয়ত করবে, ইফরাদকারী শুধু হজ্বের নিয়ত এবং কিরানকারী হজ্ব ও উমরার নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করবে।

মাসআলা : পুরুষ উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করবে এবং মহিলাগণ নিম্নস্বরে। -মানাসিক পৃ. ১০০, গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ৭৪, আদ্দুররুল মুখতার পৃ. ৪৮৪

সাইব ইবনে ইয়াযিদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার নিকটে জিবরাইল আ. এলেন এবং বললেন, আমি যেন আমার সাহাবীদেরকে উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠের নির্দেশ দেই। -জামে তিরমিযী ১/১৭১

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মহিলাগণ হায়েয বা নেফাস অবস্থায় মীকাতে এলে গোসল করবে এবং ইহরাম গ্রহণ করবে। অতপর হজ্বের আমলসমূহ সম্পন্ন করবে শুধু তওয়াফ ব্যতীত। -সুনানে আবু দাউদ ১/২৪৩

মাসআলা : ইহরামের হালতেও মহিলাদের জন্য পরপুরুষের সামনে চেহারা খোলা নিষেধ। তাই এ অবস্থায় এমনভাবে চেহারা আবৃত রাখা জরুরি যাতে মুখম-লের সঙ্গে কাপড় লেগে না থাকে। এখন এক ধরনের ক্যাপ পাওয়া যায়, যা পরিধান করে সহজেই চেহারার পর্দা করা যায়।

উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে হজ্বের ইহরাম অবস্থায় ছিলাম। হাজ্বীদের কাফেলা যখন আমাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করত তখন আমরা মাথা থেকে চেহারার উপর চাদর ঝুলিয়ে দিতাম। যখন তারা আমাদেরকে অতিক্রম করে যেত তখন চাদর সরিয়ে ফেলতাম। -সুনানে আবু দাউদ ১/২৫৪

হযরত আলী রা. মহিলাদেরকে নিষেধ করতেন তারা যেন ইহরাম অবস্থায় নেকাব ব্যবহার না করে। তবে চেহারার উপর দিয়ে কাপড় ঝুলিয়ে দিবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৪৫৩৯; আদিল্লাতুল হিজাব ৩২৯-৩৩৪; নাইলুল আওতার ৫/৭১ মানাসিক ১১৫, ফাতহুল বারী ৩/৪৭৫

মাসআলা : ইহরাম অবস্থায় ইহরামের পোশাক পরিবর্তন করা যাবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় ‘তানয়ীম’ নামক স্থানে কাপড় পরিবর্তন করেছিলেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৫০১০